পদক বাণিজ্য এড়াতে যা করে থাকি

প্রকাশিত: ৬:৫৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫

সাইদুর রহমান রিমন,

(লেখক, সিনিয়র সাংবাদিক)

কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান গড় হিসেবে ডজন ডজন ব্যক্তিকে বর্ষসেরা সাংবাদিক, শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানী সাংবাদিক, বেস্ট রিপোর্টিং এ্যওয়ার্ড, ডায়মন্ড সাংবাদিক, গোল্ডেন সাংবাদিক ঘোষণা দিয়ে পদক, সম্মাননা, ঘোষণাপত্র দিয়ে থাকে। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখার কথা বলে যাদের শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার দেওয়া হয়- তাদের অনেকে জানেনই না কোন বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য তারা মূল্যায়িত হলেন। আবার যারা সম্মাননা প্রদানের মহান (!) কাজটি করছেন তারাও শুধু একেকটি পুরস্কারের নাম নির্ধারণ করেই খালাস। কোনটা কার কাঁধে চাপানো হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনার ফুরসতও তাদের নেই।

মাস দেড়েক আগে একটি পত্রিকার ব্যানারে প্রায় ৯০ জনকে ঢাকায় এনে জাতীয় প্রেসক্লাবে শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকতার পদক গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। তাদেরই একজনের ভাগ্যে জুটেছে বছরের শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পদক আর ক্রেস্ট। হঠাৎ পদক পাওয়া চট্টগ্রামের ওই ভদ্রলোক নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, ‘মানবাধিকারের কর্মী হিসেবে আমি গ্রামগঞ্জে গিয়ে কখনও কখনও বিচার-আচার, সমঝোতার কাজ করে থাকি। আমাকে বানিয়ে দেওয়া হলো সাংবাদিক- তাও আবার শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানী সাংবাদিক। আমার সঙ্গী সাথিরাও এসব নিয়ে টিটকারি দিচ্ছে। ভালো একটা বিপদে পড়েছি।’

চট্টগ্রামের স্বশিক্ষিত মাঈনুদ্দিন সহজ সরল মানুষ, আরো সহজ তার স্বীকারোক্তি। অর্থবিত্ত আছে বলে তাকেও পদক ব্যবসায়ীরা টার্গেট করেছে এবং মুহূর্তেই বানিয়ে দিয়েছে শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধানী সাংবাদিক। কিছুদিন আগেও মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক মার্কেট ছিল শ্রেষ্ঠ ক্রাইম রিপোর্টার বানানো পদকের। মতিউরের ছাগল কাণ্ড, হায়দার আলির উদঘাটিত আইজিপি বেনজিরের সাতকাহন, বালিশ কাণ্ড, মেজর সিনহা হত্যা রহস্য ফাঁসের পর থেকে মার্কেট এখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের। এ কারণে আরিচা রোডে বাস দুর্ঘটনায় ছয়জন হতাহতের মতো দৈনন্দিন খবর, সরল সংবাদ প্রস্তুতকারী শিক্ষানবিশ সংবাদদাতাও নিজেকে ইদানীং অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। এদেশে ‘করোনা অন্তিমদশা’র মতো ’অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও’ চরম বিপাকে পড়েছে- এখন যেন পালাই পালাই করছে।

বিব্রতকর এ কথাগুলো হঠাৎ কেন উল্লেখ করলাম তা জানাচ্ছি এখন। পুরান ঢাকার অধিবাসী, আমার খুব আদরের সাংবাদিক আল বারু মোস্তাকিম নিবিড়। সে দৈনিক মানবকন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার- তবে আরো আগে থেকেই দ্য টাইমস অব ঢাকানামে চমৎকার একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করে আসছে। পোর্টালটির মানের প্রশ্নে নিবিড় বরাবরই আপোসহীন। মাঝেমধ্যে আমি নিজেও সেখানে লেখা পাঠাই, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার প্রশ্নে ভার্চুয়াল মত-অভিমতও দিয়ে থাকি। কোনো কিছু উপস্থাপনের ক্ষেত্রে টাইমস অব ঢাকা যেমন রঙচঙ মাখে না, তেমনি মত-অভিমতও প্রচার করে আনকাট অবস্থায়। এ কারণেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটির ব্যাপারে কিছুটা তৃপ্তিবোধ তৈরি হয়েছে বৈকি।

টাইমস অব ঢাকা থেকে গত ২ জানুয়ারি সম্মাননা সংক্রান্ত চিঠি পাই। পরদিনই আমি জানার চেষ্টা করেছি যে, কোন প্রতিবেদনের জন্য আমার প্রতি এ মহানুভবতা? গত আড়াই বছরে আমার মাত্র ছয়টি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে- কিন্তু কোনো প্রতিবেদনেই তো আমার প্রকৃত নাম ব্যবহার করিনি? দ্য টাইমস অব ঢাকা’র তো বিষয়টি জানার কথা নয়? মূলত কোনোরকম বিতর্ক এড়াতেই এসব খোঁজ খবর নিয়ে তবেই সম্মাননা, পুরস্কার, পদকের দিকে হাত বাড়ানো উচিত। কেমন চলে পদক বাণিজ্য তার ধারণা নিতে শুধু গুগোলে ‘টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ট্র্যাব) অ্যাওয়ার্ড’ লিখে সার্চ দিয়ে নিজেই দেখে নিন। বছরে কত বার, কত জনকে পুরস্কার দেওয়া হয়-তা দেখে হতবাক হতে হবে। তাদের নিত্য পদক প্রদান বাণিজ্যে কারা যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন- সেসব বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এসব নোংরামির কারণেই সাদা মনে কেউ সম্মান জানাতে এলেও সন্দেহ উকি দেয়, ভয় ঢুকে।

দুই দফা ওই প্রতিষ্ঠানটিতে ঢু মেরেই প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক জবাব পেয়েছি। টাইমস অব ঢাকা’র এডিটর আল বারু মোস্তাকিম নিবিড় সরল স্বীকারোক্তি দেন। তিনি জানান, সম্পর্কজনিত কারণেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রবীণ একজন অধ্যাপককে আমাদের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি জানিয়ে তার সার্বিক সহায়তা চাই। এর বিপরীতে স্যারের চাওয়া সব সনদপত্রের ফাইল তৈরি করে এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনে সাঈদুর রহমান রিমন নাম উল্লেখ করে প্রকাশিত (২০১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত দশ বছর সময়সীমা) তিন শতাধিক বিশেষ বিশেষ প্রতিবেদনের ইমেজ কপি জমা দেই। সেখান থেকে অনুসন্ধান ভিত্তিক ৩৭টি রিপোর্ট চূড়ান্ত করে বলা হয়েছে- রাষ্ট্র ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট এগুলোই যুগান্তকারী রিপোর্ট।

এরপর জানার বিষয় ছিল- সম্মাননা অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ হচ্ছে কীভাবে? সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সম্মাননা প্রদানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে টাইমস অব ঢাকার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন, কেক কাটা এবং শেষে ব্যান্ড দলের সঙ্গীতানুষ্ঠানের প্ল্যান চূড়ান্ত করা আছে- এর মাঝেই আজীবন সম্মাননা প্রদানের জমজমাট পর্বটি সংযুক্ত করা হবে। এছাড়াও চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে অংশ নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখা কয়েকজনকে পুরস্কৃত করার কথাও জানানো হয়।

সর্বশেষ জানার বিষয়টি ছিল, আজীবন সম্মাননা প্রদানের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি কি আশা করে?

এমন প্রশ্নের জবাবে টাইমস অব ঢাকার এডিটর বলেছেন, সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে যে-সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আপনি করেছেন তা এদেশে নজিরবিহীন। সেই ২০০২ সালে আরাকানের দুর্গম পাহাড়ের গোপন সামরিক প্রশিক্ষণ স্থল থেকে বার্মা লিবারেশন আর্মি প্রধান ড. মং ফোল্লার সাক্ষাৎকার গ্রহণের স্কুপ নিউজ করেছেন। তারও আগে ১৯৯৮ সালে আপনি গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি আদায়ের নির্মমতা উদ্ঘাটন করে লিখেছিলেন সাড়া জাগানো রিপোর্ট: আগে টাকা পরে লাশ যাবে কবরে। গারো পাহাড়ে বিপন্ন মানবতা, সুন্দরবনের কান্না হালুয়াঘাট সীমান্তে কি হচ্ছে? সীমান্ত সংঘাত এবং পঁচাত্তরের প্রতিরোধ যুদ্ধের অজানা কাহিনি নিয়ে তৈরি করা সিরিজ রিপোর্টগুলো ভুলার মতো নয়।

আবার বলতে থাকেন নিবিড়-সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল উলফা, নাগা বিদ্রোহী, এনডিএফবি, আচিক ফ্রন্টসহ ভারতীয় ৯টি উগ্রবাদী সংগঠনের সশস্ত্র গেরিলাদের বাংলাদেশ সীমান্তের অভ্যন্তরে অবাধ বিচরণ, আনুষ্ঠানিক ক্যাম্প গড়ে তোলাসহ নানা অপরাধ সংঘটনের বিষয়াদি নিয়ে করা অনুসন্ধান সমূহ। সংশ্লিষ্ট গেরিলা সংগঠনগুলোর ক্যাম্প সমূহ, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও কমান্ডারদের ছবিসহ সাক্ষাৎকার সংগ্রহের মতো ভয়ানক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন আপনি। ক্যাসিনোকাণ্ড, পার্বত্য অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার সর্বশেষ সশস্ত্র পাঁয়তারা নিয়েও গভীর অনুসন্ধান ফুটে উঠেছে সাঈদুর রহমান রিমনের প্রতিবেদনে।

মোস্তাকিম নিবিড় বলেন, কয়েক হাজার লিড রিপোর্ট প্রস্তুতকারী হিসেবে রিমন গড়েছেন জীবন্ত ইতিহাস। আমরা গুণীজন হিসেবে তাকে সম্মানিত করে নিজেদেরই মর্যাদাবান করে তুলছি। অচিরেই দ্য টাইমস অব ঢাকা সাঈদুর রহমান রিমনের সবগুলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরসমূহে উন্মুক্ত প্রদর্শনীরও উদ্যোগ নিতে চায় ।