নরসিংদীর সাবেক পুলিশ সুপার  কাজী আশরাফুল আজীমের ভয়াবহ দুর্নীতি ও অপরাধের আমলনামা ১

প্রকাশিত: ৬:২০ অপরাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২৫

অপরাধ জগত রিপোর্ট :

– দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে ধরা পড়েছেন স্বরাষ্ট্র ও পুলিশের ৯৬ জন কর্মকর্তা। এই তালিকায় রয়েছেন নীতি-নৈতিকতাহীন ও ভয়ংকর চরিত্রের পুলিশ কর্মকর্তা কাজী আশরাফুল আজীম, যিনি ২০০৫ সালে পুলিশে যোগদানের পর থেকে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।

সর্বশেষ ডিএমপির উত্তরায় ডিসি হিসেবে কর্মরত থাকলেও, এর আগে তিনি নরসিংদী ও শেরপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠেছে।
অবৈধ সম্পদের পাহাড় ও ক্ষমতার অপব্যবহার
পুলিশের ২৪তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা এমন কোনো অনিয়ম নেই যা করেননি।

দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। এমনকি বাবাকে পৌর মেয়র বানাতেও তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শেরপুরের পুলিশ সুপার থাকাকালে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি ১০-১২ কোটি টাকা অবৈধভাবে রোজগার করেছেন বলে জনশ্রুতি আছে।
নরসিংদীতে অপরাধের রাজত্ব এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন
অনুসন্ধানে জানা যায়, কাজী আশরাফুল আজীম নরসিংদীতে থাকাকালীন সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করেছেন। দুর্নীতির পাশাপাশি তিনি বিএনপি দমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার সময়ে নরসিংদীতে দিন-দুপুরে হত্যা, ডাকাতি, চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই ও দস্যুতা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনের বাড়িঘর ভাঙচুর ও পুড়িয়ে ফেলা হয় তার অনুগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে, যা পুলিশের সামনেই ঘটেছিল।
আরও ভয়াবহ অভিযোগ হলো, তার নির্দেশেই পুলিশ গুলি করে ছাত্রদলের দুই নেতা সাদেকুর রহমান (৩২) ও আশরাফুল ইসলামকে (২০) হত্যা করে। পরবর্তীকালে, নিহত সাদেকুর রহমানের বড় ভাই আলতাফ হোসেন বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন, যেখানে খায়রুল কবীর খোকন ও তার স্ত্রী শিরিন সুলতানাসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়।

  1. তবে, বাদী আলতাফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান যে আসামিদের নাম পুলিশই দিয়েছে এবং তিনি নিজে কারো নাম দেননি। তিনি আরও বলেন, ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না এবং পুলিশই সবকিছু জানতো। উল্লেখ্য, ঘটনার দিন খায়রুল কবীর খোকন ও শিরিন সুলতানা ঢাকায় ছিলেন।
    কাজী আশরাফুল আজীমের আমলে নরসিংদীতে অসংখ্য অপরাধ সংঘটিত হলেও, মামলার সংখ্যা ছিল নগণ্য। অভিযোগ রয়েছে, অপরাধের সংখ্যা কাগজে-কলমে কম দেখিয়ে তিনি ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ পুলিশ সুপার হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। বিএনপি দমনে তার সক্রিয় ভূমিকার কারণে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাকে খুবই পছন্দ করতেন।
    চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট
    আশরাফুল আজীমের নির্দেশনায় ট্র্যাফিক পুলিশ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ব্যাপক চাঁদাবাজি চালাতো। মাল বোঝাই ট্রাক, কাভারভ্যান, লরি এবং যাত্রীবাহী বাস ও লেগুনা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো, যা ‘পুলিশ কল্যাণ তহবিল’-এর নামে তোলা হলেও আজীমের পকেটে যেত।
    এছাড়াও, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে ভারত থেকে আসা অবৈধ মালামাল থেকে ডিবি পুলিশ প্রতি মাসে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করতো, যার পুরোটাই আজীমের পকেটে যেত। মাদক ব্যবসায়ীদেরও নিয়ন্ত্রণ করতো তৎকালীন ডিবি পুলিশ, যার মাধ্যমে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আজীমের পকেটে ঢুকতো। তৎকালীন জেলা যুব মহিলা লীগের সদস্য সচিব নাজমা বেগম, যার বাবা ও ভাই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন, তিনি পুলিশকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিতেন। এই টাকাও আশরাফুল আজীমের কাছে যেত বলে অভিযোগ রয়েছে।
    ব্যবসায়ীদের উপর প্রভাব এবং অবৈধ সম্পদ
    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আশরাফুল আজীম একজন ভয়ংকর ও অসাধু পুলিশ অফিসার ছিলেন। তার আমলে নরসিংদীতে অর্ধশতাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এবং মাদকসহ নানা অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
    তিনি নরসিংদীর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতেন। এমনকি কোরবানির জন্য গরু নেওয়ার অভিযোগও লোকমুখে শোনা গেছে। শিল্পপতিদের কাছ থেকেও তিনি মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। জানা গেছে, তার ও তার স্ত্রী এবং স্বজনদের নামে রাজধানী ঢাকায় ও ঝিনাইদহে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
    দুদকের এই তদন্ত আশরাফুল আজীমের দীর্ঘদিনের অপকর্মের অবসান ঘটাবে বলে আশা করা হচ্ছে।